প্রবাসে পরিচয় সংকট
- Admin
- Oct 6, 2022
- 3 min read
এক বছর হয়ে গেল দেশের বাইরে আছি। সবকিছু মিলিয়ে ভালোই আছি। ভালো থাকার চেষ্টা করছি। তবে একটা বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যেমনটা দেশে থাকলেও ঘটত। বলে রাখা ভালো, আমি জাতিতে গারো হওয়াই, অনেকেই চাকমা, ত্রিপুরা বা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলত। অনেকেই প্রথম দেখাতেই সরাসরি জিজ্ঞেস করতেন, তোমার বাড়ি রাঙামাটির কোন এলাকায় নাকি বান্দরবানে?

ঢাকার রাস্তায় বের হলে মাঝেমধ্যেই অন্য রকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতাম। কিছু এলাকায় ‘চাকমা চাকমা’ বলে ডাকত। খুব সাবলীলভাবেই অনেকেই ‘চিং চং পং’ শব্দটা ব্যবহার করত। মাঝেমধ্যে খুব উপভোগ করতাম। আবার মাঝেমধ্যে যে বিরক্ত হতাম না, তা নয়। প্রচণ্ড বিরক্তও লাগত। এখন এই একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি দেশের বাইরেও। বাংলাদেশি বললে, সঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে হয়।
১.
আমি যে সংগঠনে কাছেই সংগঠনের ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাসেম্বলি’ অনুষ্ঠিত হয় আফ্রিকার জাম্বিয়াতে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করেন। আমি এশিয়া প্যাসিফিকের সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্বে থাকায় আমিও অংশ নিই। পুরো প্রোগ্রামের প্রথম তিন দিন আমাকে বারবার পরিচয় দিতে হয়েছে একজন ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে। মজার বিষয় হচ্ছে, আমি যখনই বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতাম, তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। বারবার ব্যাখ্যা দিতে হতো। আমাকে জিজ্ঞেস করত, কীভাবে সম্ভব। তোমার চেহারা তো পুরোই আলাদা। বাংলাদেশি দেখতে তো অন্য রকম! তোমার মা বা বাবা কি চায়নিজ? অদ্ভুত প্রশ্ন! আবার আমার পদবির ১২টা বাজিয়ে ছাড়ত। অবশ্য দেশেও সেটা ঘটত। ‘নকরেক’ থেকে টানাটানি করে ‘নকরেট’, ‘নখরেখ’ ‘নকেক’ অনেকে ‘নরকে’ও নামিয়ে ফেলত অনেক সময়।
২.
লকডাউনের আগে অফিসের কাজে ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছিলাম। যতবারই গিয়েছি ততবারই মজার মজার ঘটনা ঘটেছে আমার সঙ্গে। হোটেল থেকে শুরু করে পথচারী, এমনকি বাস বা ট্যাক্সির ড্রাইভাররাও তাঁদের নিজস্ব ভাষায় জিজ্ঞেস করতেন। বাংলাদেশি বললে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। সেই একই প্রশ্ন, তুমি তো দেখতে বাংলাদেশিদের মতো না! জিজ্ঞেস করতাম, কেমন? হেসে ফেলতেন।
জাকার্তা থেকে এক দিন আগেই বোগোরে চলে গেলাম প্রোগ্রাম থাকায়। রাতের খাবার খেতে স্থানীয় এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার ঝুলন্ত একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি। আমার সঙ্গের জন সিগারেট কিনতে যাওয়াই, আমি নিজেই অর্ডার দিতে গেলাম। আমি ইংলিশ দিয়ে জিজ্ঞেস করছি আর রেস্টুরেন্টের মধ্যবয়সী মালিক বাহাসাই উত্তর দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বুঝতে পারছিলাম না আসলে তিনি কী বলছেন বা বলতে চাইছেন। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর, সাড়া না পেয়ে এসে বসে পড়লাম। শেষে আমার সঙ্গের জন ফিরে এলে সেই অর্ডার করেন। খাবার পর, রেস্টুরেন্টের মালিক এসে আমার কাছে বারবার দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে সেই যুবকটি যা বললেন তা শুনে থ হয়ে গেলাম। আসলে মালিকটি আমাকে ইন্দোনেশিয়ান মনে করে, ইংলিশে কথা বলায় রাগ করেছিলেন। তাই পরে যুবকটি পরিচয় দেওয়ায়, বারবার এসে দুঃখ প্রকাশ করছিলেন।
৩.
দেশের বাইরে অনেক বাংলাদেশিই পরিচয় না দিলে, আমাকে বাংলাদেশি হিসেবে চিনতে পারে না। বাংলায় জিজ্ঞেস করলে অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর প্রথম প্রশ্ন করেন ‘আপনি কি চাকমা?’ আপনার বাড়ি কি পাহাড়ে?
২০১৮ সালের ভ্যাটিকানে তালপত্র রোববারের দিন (Palm Sunday) এক বাংলাদেশি সেইন্ট পিটার স্কয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে খেজুরপাতা বিক্রি করছিলেন। অনেককেই কিনতে দেখলাম। আবার কেউ না কিনলে বাংলায় গালি দিচ্ছিলেন। দেখে খুব মজাও পাচ্ছিলাম, আবার মর্মাহতও হলাম। পরে পাশে গিয়ে বললাম, গালি তো ভালোই দিতে পারেন। শুনে আমার দিকে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, কিছু না বলেই তাড়াহুড়ো করে সরে পড়েন।
৪.
ফিলিপাইনে এক বছর হলো আছি। যতবারই বাইরে বের হই, ততবারই বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হতে হয়। তবে বেশির ভাগ মানুষই অল্প অল্প ইংলিশ পারে ও বুঝে। না পারলেও ইশারায় বুঝিয়ে দেয়। অনেকেই ফিলিপিনো মনে করে তাগালোগ ভাষায় জিজ্ঞেস করে। বিদেশি জেনে ফেললে খুব লজ্জা পায়, বিনয়ের সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে। রাস্তায় যদি বিদেশি জেনে ফেলে অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত বায়নার সম্মুখীন হতে হয়। তবে একজন বিদেশি হিসেবে যেসব ঝামেলা পোহাতে হয়, আমার চেহারার কারণে অনেক সময় সেসব ঝামেলা থেকে মুক্তিও মেলে। তবে মাঝেমধ্যে ফিলিপিনো হিসেবে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেগুলো অদ্ভুত ধরনের অভিজ্ঞতা।
একবার একটি মিটিংয়ে গেলাম। মিটিং রুমে বসে আছি। কেউ জিজ্ঞেস করছে না। আমিও আর নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু বললাম না। প্রায় ১০ মিনিট পর আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, মিটিং কখন শুরু হবে? তার উত্তরের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। পরে আমি পরিচয় দেওয়ার পরই লজ্জা পেয়ে দুঃখ প্রকাশ করে মিটিং শুরু করলেন। আসলে তারা আমাকে ফিলিপিনো মনে করে জিজ্ঞেস করেনি। আসলে তারা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ফিলিপিনো চেহারা হওয়াই তারাও আর পাত্তা দেয়নি শুরুতে।
প্রতিবারই, যখনই কোথাও না কোথাও যাই, ততবারই আমার চেহারার কারণে ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। সে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। ইন্দোনেশিয়ায় গেলে ইন্দোনেশিয়ান, ফিলিপাইনে এলে ফিলিপিনো। মোদ্দাকথা, আমি এক পরিচয় সংকটে ভুগছি। এক বড় ভাইকে আমার এই অভিজ্ঞতার কথা বলায় তিনি হেসে বলে উঠলেন, তোমার এশীয় চেহারার সুবিধাগুলো উপভোগ কর। সত্যিই, অভিজ্ঞতাগুলো উপভোগ করার মতোই!
*লেখক: এশিয়া প্যাসিফিক সমন্বয়কারী, ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট অব কাথলিক স্টুডেন্টস, এশিয়া প্যাসিফিক, ম্যানিলা, ফিলিপাইন।
প্রকাশঃ প্রথম আলো, ১১ মে ২০২০। Click here
Comments